গত দু সপ্তা নড়তেচড়তে পারিনি ধরতে গেলে। ঢাকা কমিক্সের বোর্ড এর বইয়ের কাজ আর অফিসের ঈদ সংখ্যার একগাদা ইলাস্ট্রেশনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম খুব। দম ফেলার ফুরসত পাইনি ধরতে গেলে। আজ অফিসে গিয়ে দিয়ে আসলাম সব। ওখানে বসেও দুই তিনটা কাজ করতে হয়েছিল :|
ব্লগে একটা বিষয় নিয়ে লিখব লিখব করে লেখার সময় পাচ্ছিলামনা। তবে যা বুঝলাম তাতে ফ্রি হওয়া বলে কিছু নাই। সব মিডিয়ার সৃষ্টি।
আমার আঁকাআঁকির শুরু ছোটবেলা থেকেই। ক্লাস থ্রি - ফোর এই দুবছর ছিলাম মামাবাড়িতেই। কারন ছিল স্কুল কাছে আর সেজোমামা! সেজোমামা মেঝোমাসি এই দুজনেই মাস্টার। তাই আমার, রনেলের আমাদের দুজনের পড়ালেখা করাতেন সেজোমামা। মামার কাছে আরো কজন প্রাইভেট পড়তে আসতো আর আমরাও তাদের সাথে বসে যেতাম। কখনো মার খাইনি কারন সেজো মামা নরম স্বভাবের মানুষ। তবে ছোট মাসির কাছ থেকে ভালই মার খেয়েছিলাম আমরা। :D
যাই হোক, মামার বাড়ির ছাদে আমি আর আর রনেল প্রায় সময়ই হানা দিতাম। গ্রামের বাঁশের বেড়ার ঘরের ছাদ মানে অন্য রকম ব্যাপার। চালের নিচে আর রুমের সিলিং এর মাঝখানের যে ফাঁকা জায়গাটা থাকে সেখানে বিভিন্ন রকম জিনিসপত্র রাখা হতো। হাঁড়িপাতিল। আলুর বস্তা, পুরনো জিনিসপত্র এসব। এখানে আমি উঠে বসে থাকতাম আর পুরনো ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতাম। সেখানেই একদিন পেয়ে যাই মেঝো মাসির প্রাইমারি স্কুল ট্রেনিং এর লগ খাতা। এর মধ্যে কিছু খাতা ছিল আঁকাআঁকির। অনেক রঙিন রঙিন আঁকা। ওসব আঁকা দেখেই আঁকা শুরু। কপি করতাম দেখে দেখে। রনেলের জন্য রং পেনসিল আনতো মেঝো মেসো। সে ওসবের ধারেকাছে ছিলনা। ওসবের সদব্যাবহার করতাম আমি। হাই স্কুলে উঠার পর বাবা প্যাস্টেল কালার কিনে দেয় আর স্কেচবুক। আঁকাআঁকির শুরু। টিভিতে কার্টুন শো দেখতাম আর ক্যারেক্টারগুলিকে আঁকার চেষ্টা করতাম।
সুইডিশ পলিটেকনিকে পড়ার সময় আঁকাআঁকির পরিমাণ বেড়ে যায়। দিনভর হৈহল্লা, বই পড়া, চিল্লাচিল্লি আর আঁকাআঁকি নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। হোস্টেলের রুমের দেয়ালে, ডেস্কে, টিশার্টে, জিন্সে, নোটে সবখানে চলতো। তখন সুমিতদার কাছে আলপনা আঁকায় হাতেখড়ি। এরপর ভার্সিটি অ্যাডমিশনের জন্য প্রায় এক বছর আঁকাআঁকি বন্ধ রাখি ২০১০ এ। ১১ তে যেয়ে ইউনিভার্সিটি লাইফ শুরু। ক্লাস যেদিন শুরু হবে তার আগের রাতে বড় ভাইরা ডেকে নিয়ে আমাকে, সুজয়কে আর রানাকে বলল, আলপনা কর। আবার শুরু। তিনজনে মিলে ক্যাম্পাসের এখানেওখানে, সংগঠনের প্রোগ্রামে, ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রামে, সৃজনী এর প্রোগ্রামে সবখানে রং এর বালতি আর ব্রাশ নিয়ে রংবাজি করে বেড়াতাম। এর মধ্যে বন্ধু সুজয় আমাকে ফটোশপ এর কাজ শেখায় আর আমিও ইউটিউব থেকে দেখে দেখে অনেক কিছু হাতে আনলাম ফটোশপের।
২০১২ এর দিকে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখি। ট্র্যাডিশনালি কার্টুন এঁকে ডিজিটাল মিডিয়ামে কালার করার একটা টিউটোরিয়াল। ওটা ছিল কার্টুনিস্ট মেহেদী হক এর (পরে যার হাত ধরে আমার কার্টুনিস্ট হওয়া। আমার পরম গুরু)। সেটা দেখে আমার সামনে একটা নতুন জগত খুলে গেলো। এর আগে রস আলো আলপিন বিচ্ছু এসব ফান সাপ্লিমেন্টের কার্টুন গুলি দেখতাম আর ভাবতাম এতো স্মুথলি কালার কন্ট্রোল কিভাবে করে আর্টিস্টরা! সে রহস্যের সমাধান পাই মেহেদী ভাইয়ের সেই পোস্টে। ফেসবুকেই ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ এবং উনার ব্লগ ফলো করা শুরু। ফেসবুকে আকান্তিস গ্রুপে আঁকা দেখতাম নিজেও আঁকার চেষ্টা করতাম। ফিডব্যাক নিতাম আর প্রচুর পরিমানে ভুলভাল এঁকে যেতাম। শুভ ভাই, আসিফ ভাই, মেহেদী ভাই সহ আরো অনেক আর্টিস্টদের কাজ দেখে দেখে রিয়েলিস্টিক, চিবি, স্টাইলাইজড কোন রকম আঁকার চেষ্টাই বাদ দেইনি। পোর্ট্রেট, ক্যারিকেচার সব রকম আঁকার চেষ্টা ছিল। আস্তে আস্তে হাত আসা শুরু করলো বুঝতে চেষ্টা করতে থাকলাম কোন টাইপ এর ড্রয়িং আমাকে স্যুট করে। ২০১৪ এর বইমেলায় গুরু মেহেদী ভাইয়ের সাথে আমার সামনাসামনি প্রথম দেখা। উনার "কার্টুন আঁকিবার ক, খ, গ ও ক্ষ" বইটা হাতে পাওয়া। উনাকে বলেছিলাম ভাইয়া আমিও কার্টুনিস্ট হতে চাই। উনি বলেছিলেন গ্রেট। সে থেকে শুরু। কোচিং এর ক্লাস নিয়ে পাওয়া টাকা দিয়ে গ্রাফিক ট্যাবলেট কিনলাম (যেটা ছিল ভুল এবং ঠিক কাজ দুটোই )। কার্টুন আঁকতাম ভুলভাল। হার্ডকোর অ্যানাটমির জন্য প্রোকো এর চ্যানেল আবার স্টাইলাইজড ড্রয়িং এর জন্য ইউটিউবের শত শত চ্যানেল সব রকম টিউটোরিয়াল দেখা ফলো করার কারনে গিট্টু খেয়ে গিয়েছিলাম। শতের উপর টিউটোরিয়ালে হার্ডড্রাইভ ভর্তি হয়ে গেলো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিলোনা, ক্লাসে স্কেচবুক নিয়ে যেতাম, আঁকতাম এটাওটা। প্রচুর সময় ব্যয় করতাম ফটোশপ আর স্কেচবুকে। এরপরেও ভাল হতোনা। এখন এসে বুঝতে পারি আসলে তখন আমার শেখার পদ্ধতিতে গণ্ডগোল ছিল। (এখনো গণ্ডগোল থেকেই গিয়েছে :D)
২০১৫ এর শেষ দিকে এসে ইউনিভার্সিটি লাইফ শেষ হলো। কিছুদিন আম্রিকা যাওয়ার জন্য জিআরই আবার কিছুদিন সরকারি চাকরীর জন্য পড়াশোনা, পরিবার আর এরওর চাপে পড়ে বিসিএস এর একটু আধটু স্বপ্ন সবকিছুই দেখেছিলাম গ্র্যাজুয়েশন শেষে। পরে সব শেষে এক ভাইয়ের সাথে আড্ডায় উনার বুদ্ধিতে শুরু করলাম ফ্রিল্যান্সে আঁকাআঁকি আর মজা পেয়ে গেলাম।
আরে বাহ! জোশ তো! ছবি এঁকে তো দেখি কোনরকমে চলার মতো ইনকাম করা যায়! এটাই করিনা কেন তাইলে? বাবা মা চাচা চাচি ফুফু মামা তামা সবার চোখরাঙ্গানি দাঁতখিঁচুনি কে পাত্তা না দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে প্রফেশনাল লাইফ শুরু করলাম আঁকাআঁকিতেই... মাথায় এটাই ছিল দেখি কি হয়। আর কিছু না হলে তো ডিগ্রী আছেই। ডিগ্রী কাজে লাগিয়ে চাকরি নেব।
প্রফেশনালি আঁকতে গিয়ে আস্তে আস্তে টের পেলাম কেন আমার আঁকা ভাল হচ্ছিলোনা। সমস্যাটা ছিল, "এক লাফেই আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা"। স্কেচবুকে পেনসিলকে হাতে আনার আগেই ডিজিটাল মিডিয়ামের প্রতি ইন্টেরেস্ট দেখাতে গিয়েই সব লেজেগোবরে করে ফেলেছিলাম। এখন কোন নতুন কেউ যদি আমার কাছে পরামর্শ চাইতে আসে কিভাবে আঁকবে বা শুরু করবে, আমি প্রথমেই বলি যেন ডিজিটাল মিডিয়াম থেকে এক হাজার হাত দূরে থাকে। যে ভুলটা আমি করেছিলাম আমি চাইনা সেটা আর করুক। ডিজিটাল মিডিয়াম যে খারাপ সেটা না। অনেক সুবিধাই পাওয়া যায়। কিন্তু পেনসিলকে বাগে আনার আগে ডিজিটাল মিডিয়ামে হাত দেওয়া বোকামি। অনেকে মনে করে ওয়াকম ট্যাবলেট হাতে পেলেই আর্টিস্ট হওয়া যায়! দেখে হাসি পায়। আমিও মনে করতাম একসময়। এখন টের পাই আঁকতে জানলে মিডিয়াম ব্যাপার না। তবে মেহেদী ভাই আসিফ ভাই সবারই সাজেশন স্কেচবুক। এরপর বাকি সব। আমিও এটাই বলি। এটাই আদি ও আসল। আমি এখন যত কার্টুনই আঁকি সবগুলির থাম্বনেল আগে স্কেচবুকে এঁকে নেই যতই ব্যস্ততা থাকুক। এরপর ডিজিটাল মিডিয়ামে বাকি কাজ। কাজ অনেক কমে যায়। কারন আমার কাছে সাজেশন থাকে কোথায় কোন লাইনটা হবে।
২০১২ থেকে ২০১৫ এই কবছরে যে কিছুই শিখিনি তা নয়। অনেক কিছুই শিখেছি। ডিজিটাল মিডিয়াম এর বেসিক এই সময়টাতেই হাতে আসে আর ভুল করেছিলাম অনেক। সে ভুলগুলির থেকে পাওয়া শিক্ষা তো আছেই। যাই শিখি কোন কিছুই আসলে বৃথা যায়না। ২০১৫ এর প্রথম দিকে ফাইনাল ইয়ার ফার্স্ট সেমিস্টারে আমি আমার প্রথম কমিশন কাজ পাই। এক ভাই ফেসবুকে আমার কাজ দেখে আমাকে নক দেন ওনার হয়ে কাজ করব কিনা জানার জন্য। ওনার জন্য ফ্রিল্যান্সে অনেক কাজই করেছিলাম। সে অভিজ্ঞতাও কাজে লেগেছে। সব ভুল শুদ্ধ মিলিয়েই গ্র্যাজুয়েশন শেষে ২০১৫ এর শেষ দিক থেকে ফ্রিল্যান্সে প্রফেশনালি কার্টুন আর ইলাস্ট্রেশন আঁকা শুরু। এর ফাঁকেই আকান্তিস স্কুল এ মেহেদী ভাইয়ের বেসিক কার্টুনিং ওয়ার্কশপ করলাম আর আকান্তিস স্কুল আর ঢাকা কমিক্সের আয়োজনে আসিফ ভাইয়ের কমিক্স ড্রয়িং ওয়ার্কশপ করলাম। সবসময় এই দুইজন মানুষের কাছ থেকে হেল্প পেয়ে এসেছি। এখনো পাই সবসময়ই। অনেক কিছুই শিখেছি জেনেছি এখনো শিখি ইনাদের কাছ থেকে।
২০১৬ এর মাঝামাঝি সময়ে "কালের কণ্ঠ" পত্রিকার "ঘোড়ার ডিম" সাপ্লিমেন্টের জন্য কাজ করেছিলাম কন্ট্রিবিউটর হিসেবে আর ২০১৬ এর শেষ দিকে এসে "দৈনিক যুগান্তর"এ কার্টুনিস্ট হিসেবে চাকরি শুরু। সে আরেক
কাহিনী। ওটার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্স চালাচ্ছিলাম অল্পস্বল্প। এই সময়ে এসে টের পাই প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ করা অনেক ইম্পরট্যান্ট একটা ব্যাপার। শেখা যায় অনেক কিছুই। ভুল ত্রুটি শেখা সব মিলিয়ে কাহিনীর আর শেষ নাই। চলছে চলবে। তো যাই হোক হ্যাপি কার্টুনিং। :)