মাঝেমাঝে ইয়াং কার্টুনিস্ট আর আর্টিস্টদের কাছ থেকে আমাদের প্রশ্ন শুনতে হয়, "ভাই কিভাবে অমুক পত্রিকায় আঁকবো, বা অমুক ম্যাগাজিনে আঁকার উপায় কি? বা কিভাবে বইয়ের কাজ করবো? তাদের এই 'কিভাবে' এর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমি আমার এই ব্লগপোস্ট সিরিজে।
কেন আর্টিস্ট আর কার্টুনিস্টদের অনলাইন মিডিয়ার পাশাপাশি প্রিন্ট মিডিয়ায় আসা দরকার
আর
তা নিয়ে এই পোস্ট এর সাথে রিলেটেড আরো দুটি বড় বড় পোস্ট (আসলেই বিশাল বিশাল পোস্ট এই দুইটা) আছে। কেউ আগ্রহী হলে উপরের লিংকগুলিতে ক্লিক করে পড়ে দেখতে পারেন লেখাগুলি। আর কেউ পড়তে না চাইলে অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন বলে পড়ে ফেলেন এই পোস্ট। :D
প্রথম কাজঃ আঁকুন
আপনি যেহেতু এই পোস্ট পড়ছেন সেহেতু আমি ধরে নেব আপনি একজন আঁকিয়ে এবং পত্রিকায় বা কোন পাব্লিকেশনের জন্য কাজ করতে চাচ্ছেন। এবং আপনার জন্য খুশির সংবাদ হচ্ছে পত্রিকা এবং পাব্লিকেশনরাও আপনাকে খুঁজছে। তবে এখানে একটা কিন্তু আছে। কিন্তুটা হচ্ছে আপনার কাজ ভাল হতে হবে। আপনি আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন "কত ভালো?" আমার উত্তর হবে, ভালোর আসলে শেষ নাই। এখন আপনি যদি কোন নির্দিষ্ট ম্যাগাজিন, পত্রিকার ফিচার অথবা বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করতে চান তবে সেই ম্যাগাজিন বা পত্রিকার কাজগুলি ফলো করুন। দেখুন তারা কি ধরনের কাজ ছাপায়। কোন কোন আর্টিস্ট এর কাজ ছাপায়। সে আর্টিস্টদের কাজ ফলো করুন। আপনার কাজের মান তাদের কাজের তুলনায় কেমন সেটা দেখুন। যদি দেখেন আপনার কাজ তাদের তুলনায় ভাল না তবে নিজের আঁকা উন্নত করুন। তাদের মত হতে না পারলেও তাদের কাজের আশেপাশে নিজের কাজের কোয়ালিটি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। কমিক্স আঁকার ইচ্ছা থাকলে কমিক্স পড়ুন, দেখুন, আঁকুন। কার্টুন বা ইলাস্ট্রেশন যা ই করতে চান তা ই টার্গেট করে লেগে থাকুন।
আর আঁকা উন্নত করতে চাইলে প্র্যাকটিসের বিকল্প নাই। এখানে একটা কথা আছে। শুধুমাত্র আঁকলেই হবেনা। যা আঁকছেন তা জেনে বুঝে আঁকতে হবে। কোন লাইন মোটা হচ্ছে কেন বা চিকন হচ্ছে কেন, কাপড়ের ভাজটা এখানে না হয়ে ওখানে হলো কেন এসব মাথায় রেখে জেনে বুঝে প্র্যাকটিস করলে ভাল ফল পাবেন। আর আঁকার ক্ষেত্রে ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ামে আঁকলেন নাকি ডিজিটাল মিডিয়ামে আঁকলেন সেটা বড় কথা না। আঁকতে জানলে যে কোন মিডিয়ামেই আঁকতে পারবেন। না জানলে ওয়াকমের লাখ টাকা দামের পেন ডিসপ্লে ধরিয়ে দিলেও আপনি আঁকতে পারবেন না।
প্রতিদিন নিজের সাথে প্রতিযোগিতা করুন। আজকে যে কাজটা করলেন কালকের কাজটা যাতে তার চেয়ে ভাল হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। আজকে আঁকাআঁকি শুরু করে কালকেই যদি মনে করেন আপনার কাজ ছাপা হওয়ার যোগ্য তবে আপনার ধারনা ভুল। প্রিন্ট মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়া আলাদা ব্যাপার। ফেসবুকে আপনার যা খুশি এঁকে পোস্ট করতে পারবেন কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়ায় এক একটা কাজ কয়েকবার চেক হয় ছাপা হওয়ার আগে। তাই কাজ ভাল করার চেষ্টা করুন।
দ্বিতীয় কাজঃ দেখান
আঁকার পর আপনার কাজ হবে দেখানো। দেখানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার চেয়ে ভাল কিছু আর নাই। কোন কার্টুন, কমিক্স স্ট্রিপ, ইলাস্ট্রেশন করার পর ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে, পেইজে অথবা বিভিন্ন আর্ট গ্রুপে শেয়ার করেন। আর্ট গ্রুপের সিনিয়র দের কাছ থেকে ফিডব্যাক নিন। নিজে চেয়ে চেয়ে ভুল ত্রুটি দেখিয়ে দিতে বলুন। কারন আপনার প্রোফাইলে শেয়ার করা ছবিতে কেউ আপনার ভুল ধরবেনা। সবাই আপনার বন্ধু তাই তারা প্রশংসাই করবে। বলবে "আরে জোশ"। এই জোশ দেখে হুঁশ হারালেন তো সর্বনাশ! মনে রাখবেন আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে আপনার পটেনশিয়াল ক্লায়েন্ট থাকতে পারে। তাই ফেসবুকে পোস্ট করার জন্য তাড়াহুড়া করে কাজ শেষ করবেন না। সময় নিয়ে নিজের সেরাটা দিয়ে কাজ করুন। এরপর পোস্ট করুন। ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ামে কাজ করলে স্ক্যান করে পোস্ট করার চেষ্টা করুন।
বিঃদ্রঃ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার পর কাওকে নিজের কাজ বা পেইজ লাইক করতে বলবেন না। এতে বাকি সব সস্তা ফেমসিকারদের মধ্যে পড়ে যাবেন নিজে। আর নিজের পেইজ/কাজ লাইক করতে বলাটা একটু সস্তা দেখায়। আপনার কাজ ভাল হলে কাওকে বলতে হবে না। লোকজন নিজেরাই লাইক দেবে।
তৃতীয় কাজঃ পোর্টফলিও বানান
এই কাজটা ইম্পরট্যান্ট। মনে করেন আপনার কাছে এখন অনেক স্যাম্পল কাজ আছে কোন পটেনশিয়াল ক্লায়েন্টকে বা এডিটরকে দেখানোর জন্য। অথবা কেউ কাজ দেওয়ার জন্য ইন্টেরেস্টেড হয়ে আপনার কাজ দেখতে চাইলো। তাহলে কিভাবে দেখাবেন? ফেসবুকের একটা গুছানো পেইজ বা ইন্সটাগ্রামের একটা প্রোফাইলে নিজের কাজগুলি গুছিয়ে রাখা যেতে পারে যেটা দেখানো যায় চট করে। তবে সবচেয়ে ভাল হয় যদি কোন পোর্টফলিও সাইট থাকে। কেউ কাজ দেখতে চাইলেই চট করে সাইটের লিঙ্ক দিয়ে দিলেন। এটা থেকে বুঝা যাবে আপনি প্রফেশনাল কেউ। ফ্রিতেই সহজে পোর্টফলিও বানিয়ে নেওয়ার অনেক অপশন আছে। যেমন Artstation, Tumblr, Blogspot, Wordrpress ইত্যাদি। এখানের কোন সাইটে একটা গুছানো পোর্টফলিও বানিয়ে নিন।
চতুর্থ কাজঃ নেটওয়ার্কিং
বল্টু পল্টু চুমকিদের সোশ্যাল মিডিয়ার ফ্রেন্ডলিস্টে রাখার পাশাপাশি প্রফেশনাল ফিল্ডের লোকদেরও ফ্রেন্ডলিস্টে রাখার চেষ্টা করুন। বিভিন্ন ম্যাগাজিনের এডিটর,পত্রিকার এডিটর, আর্টিস্টদের কে ফ্রেন্ডলিস্টে রাখুন। বিভিন্ন আর্ট গ্রুপে থাকুন এবং নিজের কাজ পোস্ট করুন। এইসব আর্ট গ্রুপে বিভিন্ন পত্রিকা বা এজেন্সির ক্রিয়েটিভরা থাকেন। তাদের চোখে আপনার কাজ পড়বে। সমসাময়িক আর্টিস্টদের সাথে যোগাযোগ রাখুন আর সিনিয়রদের সাথে যোগাযোগ রাখুন। তাদের মাধ্যমেও অনেক সময় হাতে কাজ আসে। বেশি ভাল হয় যদি এই ফিল্ডে প্রতিষ্ঠিত কাওকে গুরু ধরেন। আঁকাআঁকি আসলে গুরুমুখি বিদ্যা। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবেন, শিখতে গিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে কাওকে বেশি বিরক্ত করবেন না বা ফেসবুকে নকের পর নক দেবেন না। প্রফেশনাল রা প্রায় সময়ই ব্যস্ত থাকে তাই তারা বিরক্ত হওয়া পছন্দ করেন না। যখন আপনার মনে হবে আপনার আঁকা কোথাও ছাপা হওয়ার মতো একটা পর্যায়ে আছে তখন প্রফেশনালদের দেখান। বিভিন্ন পত্রিকার ফিচার এডিটরদের, আর্টিস্টদের মেইল করতে পারেন। জানিয়ে রাখতে পারেন আপনি তাদের জন্য কাজ করতে পারবেন। কারো আপনার কাজ পছন্দ হলে কাজ পেয়ে যাবেন। নেটওয়ার্কিং স্কিল খুবি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। কেউ যখন ইন্টেরেস্টেড হয়ে আপনার কাজ ছাপাতে চাইবে তখন কাজের সাইজ, ডেডলাইন, কাজের বিল এসব ব্যাপারে কথাবার্তা বলে রাজি হলে কাজ করে ফেলুন। নিউজপ্রিন্টের জন্য কাজ করার সময় রঙের ব্যাপারে সাবধান থাকুন। খুব বেশি গাড় রঙ এড়িয়ে যাওয়াই ভাল কারন নিউজপ্রিন্টে গাড় রঙ মার খেয়ে যায়। ইলাস্ট্রেশনের সাইজ ছোট হলে আঁকা সিম্পল রাখাই ভাল। আর কাজ করতে করতে একসময় নিজেই বুঝে যাবেন কোন কালারে কিভাবে কাজ করলে ভাল আসবে প্রিন্ট। ছাপার অক্ষরে নিজের কাজের পাশে নিজের নাম দেখতে পাওয়াটার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। ট্রাই করে দেখুন। আমার কথা সত্য কিনা। মিথ্যা হলে চা খাওয়াবো। :D
বিঃদ্রঃ সাধারনত দৈনিক পত্রিকার ফিচার বা মাসিক ম্যাগাজিন গুলির কাজ করার জন্য সময় কম পাওয়া যায়। এমনও হতে পারে পাতা পাবলিশ হওয়ার আগের দিন আপনাকে কাজ ধরিয়ে দিতে পারে কোন এডিটর। এই ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে।
কিছু এক্সট্রা উপদেশ
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার জমানা। লেখক কবি শিল্পী সবার নিজস্ব প্রতিভা সহজে শেয়ার করা যায় সোশ্যাল মিডিয়াতে। এখানে একটু সাবধান হতে হবে। কার্টুনিস্ট মিতু আপুর ভাষায়, "সোশ্যাল মিডিয়াতে ফেইম সিকিং এর ট্র্যাপে পড়াকে সচেতনভাবে এভয়েড করতে হবে।" আপনি নিজের জন্য কাজ করছেন। সে কাজ সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করছেন সেটা ঠিক আছে। কিন্তু যখনই আপনি পাবলিক ডিমান্ড বুঝে আঁকতে যাবেন তখনই আপনি আপনার স্বকীয়তা হারাতে শুরু করবেন। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিটি লাইক, কমেন্ট, শেয়ার আমাদের মস্তিষ্কের ডোপামিনে কিক দেয়। প্রতিটি রেসপন্সে আমরা খুশি হই।
আপনাকে এই লুপ থেকে বের হতে হবে। নিজের একটা সতন্ত্র আঁকার স্টাইল থাকবে। সেই স্টাইলে আঁকবেন ইচ্ছেমতো। কিন্তু যখন কারো জন্য আঁকতে যাবেন তখন হয়তোবা আপনাকে অন্যান্য স্টাইলও ফলো করতে হবে। যেমন ধরেন আপনার আঁকার ধরন খুবি রাফলি কার্টুনিশ। সে আঁকা দিয়েই আপনার ফেসবুক পেইজে হাজার হাজার লাইক কমেন্টের বন্যায় ভাসছেন। ভাল কথা। কিন্তু মনে রাখবেন এই লাইক কমেন্ট রেসপন্স ক্ষণিকের। সোশ্যাল মিডিয়ায় এতো দ্রুতই ট্রেন্ড চেঞ্জ হয় আপনার পোস্ট এর স্থায়িত্ব অল্প কদিনের। প্রিন্ট মিডিয়ার(বই, ফিচার, ম্যাগাজিন) জন্য যখন আঁকতে যাবেন তখন হয়তো দেখা যাবে আপনার রাফ স্টাইল চলছেনা। তাই বিভিন্ন স্টাইল আয়ত্ব করার চেষ্টা করুন যে স্টাইলগুলি ফিল্ডে চালু আছে। আর নিজের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করুন। নিজের গল্প, গল্পের ক্যারেক্টার তৈরি করার চেষ্টা করুন। যে গল্প, ক্যারেক্টার সম্পূর্ণই আপনার নিজের। সে গল্প পাবলিশ করার চেষ্টা করুন কোন ম্যাগাজিন বা পাব্লিকেশন থেকে। দিনশেষে এই পাব্লিকেশনই থাকবে আপনার বুক শেলফে।
অনেক বকবক করে ফেললাম এক পোস্টেই। আজ এ পর্যন্তই। কারো মতামত বা কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানাতে পারেন। আমি নিয়মিত প্রিয় শিল্পীদের ব্লগপোস্ট পড়ি, Podcast আর Art-Talk শুনে থাকি কাজ করার সময়। এই লেখা লেখার সময় যে ব্লগপোস্ট আর আর্ট-টক গুলি হেল্প করেছে সেগুলির লিঙ্ক দিয়ে দিলাম;
ড্রয়িং ভাল করতে হবে-মানে কী? - আসিফুর রহমান কার্টুনিস্ট ও আঁকিয়েদের জন্য ক্যারিয়ার টিপস্ - মেহেদী হক
Networking for Artists - 3 point perspective Podcast
My art is great, Why won't anyone hire me - 3point perspective Podcast
অসম্ভব ভালো একটি পোস্ট| সত্যি বলতে আমার চলে চলা রাস্তাটাও একদম এরকমই| আশা করি নতুন যারা তারা অবশ্যই উপকৃত হবে|
ReplyDeleteআরে সুমিতদা :D ধন্যবাদ দাদা। আমারও এভাবেই যাত্রা শুরু হয়েছিল :D
Deleteদারুন লেখা|অনেক ধন্যবাদ|
ReplyDeleteআপনাকেও ধন্যবাদ :D
Deleteভাই পত্রিকার জন্য কার্টুন আঁকতে চাই।প্রক্রিয়া টা কি?আমার আঁকা কার্টুন তাদের কাছে কিভাবে পঠাবো?
ReplyDelete