Sunday, June 16, 2019

বিগিনার কার্টুনিস্ট/ইলাস্ট্রেটরদের জন্য মেনস্ট্রিম প্রিন্ট মিডিয়ায় যাত্রাঃ ০২

এর সিরিজের আগের পোস্টে লিখেছিলাম আঁকাআঁকি নিয়ে আমার মেনস্ট্রিম মিডিয়ার যাত্রার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে। এই পোস্টে আমার প্রিয় কয়েকজন বাংলাদেশি আর্টিস্টদের প্রিন্ট মিডিয়ায় যাত্রা নিয়ে অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যাক।

নাসরীন সুলতানা মিতুঃ বাংলাদেশের প্রথম সারির কার্টুনিস্টদের মধ্যে একজন মিতু আপু। অ্যাসোসিয়েট এডিটর হিসেবে কাজ করছেন উন্মাদ ম্যাগাজিনে। বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা প্রজেক্ট টিকটালিকের ফাউন্ডার। মিতু আপুর সাথে কথায় জানতে পারি তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন উন্মাদ ম্যাগাজিনে কিন্তু প্রথম আঁকা কার্টুন ছাপা হয় বিচিত্রা ম্যাগাজিনে ২০০৬ সালে। কাজটা ছিল একটা পলিটিকাল কার্টুন। উন্মাদে কাজ করতে করতেই কার্টুনিংয়ে হাত পাকাতে থাকেন নিয়মিত আঁকার মাধ্যমে। নিয়মিত পলিটিকাল কার্টুন আঁকা শুরু করেছিলেন ২০১০ সালে নিউ এইজ পত্রিকায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়য়ে অধ্যাপনা করার পাশাপাশি নিয়মিত কার্টুন এঁকেছেন আর কমিক্স এঁকেছেন ঢাকা কমিক্সে। কাজ করেছেন বিভিন্ন প্রকাশনীর বইয়ের জন্য আর নিজের বইয়ের জন্য। এখন অধ্যাপনার পাট গুছিয়ে পুরদস্তুর আঁকিয়ে তিনি। ব্যস্ত আছেন প্রজেক্ট টিকটালিক নিয়ে।


যারা নতুন আঁকছে/ছেন তাদের উদ্দেশ্যে মিতু আপু বলেন;

"আঁকা, আঁকা এবং আঁকা। এবং সোশ্যাল মিডিয়ার উপস্থিতি দোষনীয় না, কিন্তু সহজ ফেইম সিকিং এর ট্র্যাপে পড়াকে সচেতনভাবে এভয়েড করা। আর লাস্ট একটা কথা, গত কয়দিন ধরে মনে হচ্ছে-

ড্রইং যারা করে পছন্দ করে বলেই করে, অনেকেই অনেক দারুণ দারুণ কাজ করছে এখন। কিন্তু ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চাইলে ভিশন থাকা জরুরি। যেমন তুমি ফ্রিল্যান্সিং করছ, তোমার আলটিমেট গোল কী? তোমার লাইফে নিজের কোন কাজটা তোমার ফারদার ক্যারিয়ারকে একটা জায়গায় দাঁড় করাবে? সেরকম কিছু প্ল্যান না থাকলে একটা সময়ে ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যাবার চান্স থাকে। আইডেন্টিটি ক্রাইসিস শুরু হয়। ভাল ড্রইং এর পাশাপাশি ক্যারিয়ার পাথওয়ে থাকাটাও জরুরি।

আসিফুর রহমানঃ ২০১২-১৩ তে যখন আমি আঁকাআঁকি শুরু করি তখন ফেসবুকে মেহেদী ভাই শুভ ভাইদের কাজের পাশাপাশি আরেকজন মানুষের কাজ ফলো করতাম । মানুষটি হলেন Arts By rats এর আসিফ ভাই। বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পাশ করা আসিফ ভাই নেশা থেকে আঁকাআঁকিকে পেশা হিসেবেই নিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে কনসেপ্ট আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছেন মাইটি পাঞ্চ স্টুডিওতে, ফ্রিল্যান্স কমিক বুক আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছেন ঢাকা কমিক্স আর পাঞ্জেরীতে। আঁকতে ভালবাসেন চিলড্রেন বুক। নিজের কমিক্স ক্যারেক্টার "জিতু আর টি" এর কমিক্স স্ট্রিপ আর বই আর অন্যান্য অনেক কমিক্সের পাশাপাশি কাজ করেছেন বেশ কিছু চিলড্রেন বুকে। বিভিন্ন স্টাইলে আঁকতে দেখা যায় আসিফ ভাইকে এবং সময়ের সাথে সাথে নিজের আঁকাকে উন্নত করছেন। আমার কাছে বর্তমানে বাংলাদেশের টপ আর্টিস্টদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আসিফ ভাই। এই ব্লগপোস্ট লেখার জন্য আসিফ ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিভাবে উনি প্রথম মেনস্ট্রিম প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ করার জন্য ডাক পেলেন।




আমার করা প্রশ্ন আর উনার উত্তরগুলি হুবহু তুলে দেওয়া হলো;
আপনি প্রথম কোন প্রিন্ট মিডিয়ায় (পেপার/ম্যাগাজিনে) কাজ কিভাবে পাইসিলেন?
- প্রথম পেপার/ ম্যাগাজিনে কাজ সম্ভবত রস-আলো তে। ফেসবুকের কাজ দেখে এডিটর কাজ চেয়েছিলেন। রুশ রস নাম এ একটা ফিচারে ইলাস্ট্রেশান এর জন্য।
প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ পাওয়ার আগে কয় বছর ধরে নিয়মিত একটু সিরিয়াসলি আঁকাআঁকি করছেন ?
- ২-৩ বছর। আঁকা আঁকি শুরুর দিকে ফেসবুকে ব্লগে ইত্যাদি জায়গায় নিয়মিত প্র্যাকটিস, স্কেচ, ড্রয়িং এগুলো পোস্ট হত-ক্রিটিক হত।
কখন প্রথম কোন বইয়ের কাজ করসিলেন? কিভাবে পাইসিলেন বইয়ের কাজ?
- প্রথম বই এর কাজ মাশুদুল হক এর “রাজকুমার বিলু কালু গিলু এর অভিযান”। বই এর কাজ এর জন্য নক করেছিল মাশুদুল হক। পরে প্রকাশক এর সাথে যেয়ে দেখা করে কাজ দেখাই এবং তারপর কাজটা করা হয়। সম্ভবত ২০১৩ এর ফেব্রুয়ারি মেলাতে বইটা এসেছিল।

রীশাম শাহাব তীর্থঃ পেশায় স্থপতি তীর্থ ভাই আমার খুবি পছন্দের একজন আর্টিস্ট এবং দারুন একজন আঁকিয়ে। উনার কাজগুলি জাস্ট অসাধারণ। উনার দৈনন্দিন জীবন নিয়ে আঁকা "যাপিত জীবন" সিরিজের ছবিগুলি যে আমার কি ভাল্লাগে!


তীর্থ ভাইয়ের সাথে কথায় কথায় জানতে পারি প্রিন্ট মিডিয়ায় উনার প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা হয় ক্রীড়ালোক নামে একটা পত্রিকায় ৯৫-৯৬ এর দিকে। তার পরিচিত একজন ছিল সেখানে। তিনিই কাজ দিতেন। এর পর Weekend Tribune এ কাজ করেন ২০১৮ তে এসে। এর আগে থেকে সিরিয়াসলি আঁকাআঁকি করছেন ২০১৬ থেকে। ফেসবুকে Tirtho নামের পেইজটি ঘুরে দেখতে পারেন যদি তীর্থ ভাইয়ের কাজ আগে না দেখে থাকেন। দারুন সব কাজ করে যাচ্ছেন আর উনার অনেক কাজ বাইরের অনেক ওয়েবসাইট আর পপুলার পেইজেও ফিচার্ড হয়েছিল। এখনো নামে বেনামে ফিচার হতে দেখি। :D । স্থাপত্যের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্স আঁকাআঁকি করছেন দেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের মতো পত্রিকাগুলোতে আর কিশোর আলো, কিশোর বাংলার মতো পপুলার ম্যাগাজিনগুলিতে। তীর্থ ভাই প্রথম বইয়ের কাজ করেন ৯৯ সালে। এরপর ২০১৬ তে সিরিয়াসলি আঁকাআঁকি শুরু করার পর থেক কাজ করেছেন বেশ কিছু বইয়ের কভার আর ইলাস্ট্রেশনের জন্য। ২০১৯ এর একুশে বইমেলাতেই চিলড্রেনবুক আর বই মিলিয়ে করেছেন মোট চারটা বইয়ের কাজ। সোশ্যাল মিডিয়া প্রিন্ট মিডিয়া দুই দিকই কাঁপাচ্ছেন এই দারুন মানুষটি।

নাঈম আহমেদঃ



(নাঈমের এই ছবিটা তীর্থ ভাইয়ের আঁকা।)

এই মানুষটা ভয়ানক ভাল আঁকে। নাঈম এর পড়ালেখা ছিল আর্কিটেকচার নিয়ে SUST এ। ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ার সময় থেকেই সে আঁকাআঁকি শুরু করে। নাঈমের প্রথম প্রিন্ট মিডিয়ার অভিজ্ঞতা উন্মাদ ম্যাগাজিনে। নিজের আঁকা নিয়ে এক বন্ধুর সাথে বস আহসান হাবিবের কাছে গিয়েছিল সে। সে থেকেই শুরু। কাজ করেছে উন্মাদে অনেক বছর। আর এ পর্যন্ত ১৪-১৫ টা বইয়ের কাজ করেছে নাঈম।

হাসিব কামাল: হাসিখুশি মানুষ হাসিব ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় আড্ডা বেশিদিনের নয়। গত এক দুই বছর বড়জোর! এর মধ্যেই এই মানুষটা আমার প্রিয় একজন হয়ে উঠেছেন। দুজনে মিলে একই প্রতিষ্ঠানের জন্য আর একই প্রজেক্টে কাজ করা হয়েছে বেশ কয়েকবার।


হাসিব ভাইকে আঁকতে দেখছি অনেক বছর ধরেই। কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করা মানুষটা এখন পুরোপুরিই পেশাদার ইলাস্ট্রেটর। উন্মাদ ম্যাগাজিনে আছেন অনেকদিন ধরেই। নিয়মিত আঁকছেন আর নিজের আঁকাকে উন্নত করছেন। বেশ কিছু কমিক্স আর গ্রাফিক্স নভেলের পাশাপাশি ২০১৮ এর বইমেলায় প্রকাশ করেছেন নিজের কমিক্স "বোবা আর্তনাদ"। কাজ করছেন দেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা আর মাসিক ম্যাগাজিনে। প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রথম কাজ ছিল "রস আলো" তে আর প্রথম বইয়ের কাজ করেন ২০১৪/১৫ তে। বইটা ছিলো 'সৈয়দ শামসুল হকে'র! কাজটা পেয়েছিলেন এক প্রকাশক বড়ভাইয়ের মাধ্যমে।
নতুনদের উদ্দেশ্য হাসিব কামাল বললেন - প্রচুর প্র‍্যাকটিস করো আর শেখার প্রসেসটা এনজয় করার চেস্টা করো। ইন্সপিরেশান আর আইডিয়ার জন্য নিজের চারপাশের পরিবেশ আর ক্যারেক্টারগুলোকে নিখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করো। নিজের আকা নিয়ে কখনোই ওভার কনফিডেন্ট হয়োনা, কারণ এটা তোমাকে নতুন কিছু শেখার আগ্রহকে কমিয়ে দিতে পারে।

প্রসূন হালদার:


প্রসূন হালদার এর আঁকা সম্পর্কে কিছু আর বললাম না আমি। দারুন আঁকাআঁকির জন্য অনেকেই চেনেন প্রসূনকে। সে পড়াশোনা করছে ঢাবি চারুকলায়। জলরঙের জাদুকর প্রসূন পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করছে প্রিন্ট মিডিয়ায়। কাজ করেছে কিশোর আলো, বিচ্ছু(যুগান্তর) সহ বিভিন্ন ম্যাগাজিনে। তার কাছ থেকে নেওয়া ছোট ইন্টার্ভিউ তোলে দিলাম;

১) তুমি প্রথম কোন প্রিন্ট মিডিয়ায় (পেপার/ম্যাগাজিনে) কাজ কিভাবে পাইসিলা?
- চারুকলায় ভর্তি হবার কিছুদিন পর। ফেসবুকে আমার কাজ দেখে নক দিয়েছিলো।
২) প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ পাওয়ার আগে কয় বছর ধরে নিয়মিত একটু সিরিয়াসলি আঁকাআঁকি করতেসো ?
- ৬ মাস। মূলত চারুকলায় চান্স পাবার পরই সিরিয়াসলি আঁকা আঁকি শুরু করি।
৩) কখন প্রথম বইয়ের কাজ করসো ? কিভাবে পাইসো বইয়ের কাজ?
- চারুকলায় ভর্তির আগে এস এস সি পড়ার সময় আমার বন্ধুর খালার প্রকাশনীতে কিছু কাজ করেছি বইয়ের, তবে তার মান বেশি ভাল করতে পারিনি, এর পরে আবার বইয়ে কাজ করি চারুকলায় ভর্তির প্রায় এক বছর পরে। বইয়ের নাম আমি বলতে পারবো না, আমি শুধু জলরঙে প্রচ্ছদের ছবিটা এঁকে দিয়েছিলাম।

সব্যসাচী চাকমাঃ ঢাকা কমিক্স থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় 'জুম' কমিক্স সিরিজের স্রষ্টা সব্যসাচী চাকমার আঁকাআকি শুরু ছোটবেলা থেকেই। তার সাথে কথা বলে জানা যায় সে ক্লাস থ্রি তে পড়ার সময় থেকেই কার্টুন কমিক্স এসব আঁকাআঁকি করছে। হাই স্কুলে পড়ার সময়ও নিয়মিত আঁকতো সে। প্রথম প্রিন্ট মিডিয়ার কাজ ছিল উন্মাদ ম্যাগাজিনে। ২০১৬ সালের দিকে তার এক ফ্রেন্ড উন্মাদে সব্যর কাজ পোস্ট করে। পরে সে নিজেই বস আহসান হাবিব কে মেইল করলে বস তাকে দেখা করতে বলেন। এভাবেই উন্মাদে তার যাত্রা শুরু হয়. আর রস+আলো এর এডিটর রনি ভাইয়ের সাথে সে নিজেই যোগাযোগ করে একটা কাজ পাঠায় আর বলে সে রস আলোতে কাজ করতে আগ্রহী। আঁকা দেখে রনি ভাই সেটা রসআলোতে ছেপে দেন। এরপর থেকে সে এঁকেছে রস+আলোতে আর বর্তমানে প্রথম আলো এর বিভিন্ন ফিচারে আঁকছে সে।


জুম ক্যারেক্টার আর গল্প ডেভেলপ করার পর ২০১৬ সালেই প্রথম জুম কমিক্সের ব্যাপারে সে কথা বলে ঢাকা কমিক্সের প্রকাশক মেহেদী ভাইয়ের সাথে। পুরো কমিক্সটাই সে এঁকেছিল ট্রাডিশনাল মিডিয়ামে কালি কলমে। পড়ালেখার ব্যস্ততার কারনে কমিক্সের কাজ অনেকদিন বন্ধ ছিল। পরে মেহেদী ভাইয়ের সাজেশনে কিছু পেইজ এডিট করে আবার দেখায় সে মেহেদী ভাইকে। ২০১৮ এর বইমেলায় 'জুম' এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশ পায় ঢাকা কমিক্স থেকে। এবং জনপ্রিয়তা পায় বাংলাদেশি কমিক্স রিডারদের মধ্যে। সেই জনপ্রিয়তার জের ধরে ২০১৯ এর বইমেলায় প্রকাশ পায় জুম এর দ্বিতীয় সংখ্যা।
নতুনদের উদ্দেশ্যে সব্যসাচীর মেসেজ;
আপনার কাছে কি গ্রাফিক ট্যাবলেট আছে? যদি থাকে, তাহলে ওয়াও! আপনি লিওনার্দো ডি ভিঞ্চির উত্তরসূরি। এটাই ভাবেন অনেকেই। হয়তো তারা এটাও ভাবেন, যে ডি ভিঞ্চি গ্রাফিক ট্যাব দিয়ে 'মোনালিসা' এঁকেছিলেন। গ্রাফিক ট্যাব থাকা মানেই আপনি অনেক বড় আর্টিস্ট। কিন্তু কথা হচ্ছে ভাই, আপনাকে ট্যাব কেন; যদি ডি ভিঞ্চির পেন্সিলও এনে দেয়া হয়, তাও কিন্তু আপনি ডি ভিঞ্চি হতে পারবেন না। তাই বলছি, ভাল আর্টিস্ট হতে ট্যাব লাগে না। লাগে ইচ্ছা, প্যাশন। আর আর্টিস্ট হতে ৮০০ টাকা খরচ করে স্কেচবুক কিনা লাগে না। মাত্র ১০ টাকার খাতা, আর ৫ টাকার কলম কিনেই কিন্তু স্কেচবুকিং করা যায়। আদিম যুগের মানুষরা কত কষ্টেই না ছিল। বেচারাদের স্কেচবুক ছিল না। তাই রাগে-দুঃখে গুহার দেয়ালে ছবি এঁকেছিল। আসলে কিছুই না, ইচ্ছা থাকলেই হয়। ৮০০ টাকা দিয়ে স্কেচবুক কিনতে না পেরে, আঁকাআঁকি করতে না পারাটা অজুহাত ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই ভাই, যা আছে তা দিয়েই আঁকেন। কথা কম, কাজ বেশি।

মাহাতাব রশীদঃ মাহাতাব সম্পর্কে এক বাক্যে বলতে গেলে বলা যায় "সে একটা জিনিস।" এই বছর HSC পরীক্ষা দেওয়া মাহাতাবের ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি করা অভ্যাস। কিশোর আলো তে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করত সে। যার কারনে পরিচিত অনেকেই জানতো সে আঁকাআঁকি করে। মাহাতাব সিরিয়াসলি আঁকাআঁকি শুরু করে ২০১৪ সাল থেকে। মাহাতাবের প্রিন্ট মিডিয়ায় যাত্রা শুরু ২০১৫ তে রস+আলো তে আঁকার মাধ্যমে। সিরিয়াসলি আঁকাআঁকি শুরু করার আনুমানিক দেড় বছর পর। ততদিনে তার আঁকার হাত মোটামুটি ভাল হয়েছে।



এরপর তার আঁকা হয়েছে যুগান্তর পত্রিকার বিচ্ছুর জন্য, কিশোর আলোর জন্য, বিজ্ঞান চিন্তার জন্য। ২০১৮ এর প্রথম দিক থেকে শুরু করা এবং ফেসবুকে দারুন জনপ্রিয় মাহাতাবের "মাহাকাব্য" ওয়েবকমিক্স প্রথম আলো এর ফিচার "রস আলো" তে নিয়মিত প্রকাশ হওয়ার পর এখন প্রকাশিত হচ্ছে ছুটির দিনে তে। মাহাতাব বইয়ের কাজ প্রথম করেছিল ২০১৫ তে। লেখকের সাথে ফেসবুকে পরিচয় ছিল। আর সে নিয়মিতই তার আঁকা আপলোড করতো। ওখান থেকে দেখেই তাকে নক দিয়েছিলেন লেখক। সে থেকে শুরু। বেশ কিছু বইয়ের ইলাস্ট্রেশন আর কভার করেছে মাহাতাব। ঢাকা কমিক্স আর কিশোর আলো এর জন্য করেছে কমিক্স। সর্বশেষ এই বইমেলায় HSC পরীক্ষার ব্যস্ততা সত্বেও করেছে বস আহসান হাবীব এর চিলড্রেন বুক "গোয়েন্দা আঙ্কেল" এর জন্য দারুন সব ইলাস্ট্রেশন। আবারো বলছি আমার খুবি পছন্দের একজন আর্টিস্ট মাহাতাব একটা জিনিস!

সালমান সাকিব শাহরিয়ারঃ মাহাতাবের মতোই এইবছর HSC দেওয়া সালমানের লাল লাল নাকওয়ালা ক্যারেক্টার সমৃদ্ধ একটা আঁকার স্টাইল আছে। ফেসবুকে নিজের পেইজ Shahstuff এ আঁকাআঁকি করে বেশ জনপ্রিয় এই ইয়াং কার্টুনিস্ট।


প্রথম প্রিন্ট মিডিয়ার কাজ শুরু হয় ডেইলি স্টার এর শাউট ম্যাগাজিনের কভার করার মধ্য দিয়ে । এঁকে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার পাশাপাশি ফেসবুকে নিজের পেইজে আর র‍্যান্টেজেস পেইজের জন্য ইলাস্ট্রেশন করতো সালমান। র‍্যান্টাজেসে কাজ করতে করতে রুম্মান ভাই তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেন শাউট এর কভার করতে আগ্রহী কী না। সেখান থেকেই শুরু। তারপর কিশোর আলো, রস+আলো, বিচ্ছু সবখানে কাজ করেছে সালমান। আর প্রিন্ট মিডিয়ায় আসার ২ বছর আগে থেকেই সিরিয়াসলি ইলাস্ট্রেশন আর কার্টুন আঁকায় ফোকাস করে সে। বর্তমানে ফ্রিল্যান্স ইলাস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করছে Daily Star এর ফিচার পাতা Shout এ।

রাকিব রাজ্জাকঃ কিশোর আলো ম্যাগাজিন এর নিয়মিত আঁকিয়ে রাকিব রাজ্জাকের প্রিন্ট মিডিয়াতে আঁকাআঁকি শুরু কিশোর আলো এর হাত ধরে। সোশ্যাল মিডিয়াতে তার আঁকা দেখে আর আঁকাআকির ইচ্ছা দেখে তার কাছে থেকে কাজ নেয় কিশোর আলো। আর কালের কন্ঠ পত্রিকার ফিচার পাতায় আঁকা দিয়ে শুরু হয় দৈনিক পত্রিকায় কাজ করা। কাজ করেছে দৈনিক যুগান্তর আর প্রথম আলো তে। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি করতো রাকিব তবে একটু সিরিয়াসলি আঁকা শুরু করার ৪-৫ মাসের মধ্যেই সে প্রিন্ট মিডিয়ায় ডাক পায়।



বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করার জন্য রাকিব প্রথম ডাক পেয়েছিল ২০১৭ তে কিন্তু সেবার সে কাজটা করেনি। এইবছর বইমেলায় সে চারটা চিলড্রেন বুক ইলাস্ট্রেশন করেছে শুভ্রপ্রকাশ এর জন্য। বিভিন্ন ম্যাগাজিন আর পেপারে রাকিবের কাজ দেখে ওরা রাকিবকে কাজটা দেয় বলে জানিয়েছে রাকিব।

মাঝেমাঝে ইয়াং কার্টুনিস্টদের কাছ থেকে আমাদের প্রশ্ন শুনতে হয়, "ভাই কিভাবে অমুক পত্রিকায় আঁকবো, বা অমুক ম্যাগাজিনে আঁকার উপায় কি? বা কিভাবে বইয়ের কাজ করবো?
একটি পত্রিকার একটা সাপ্লিমেন্টে অথবা একটা ম্যাগাজিনের বিভিন্ন আর্টিকেল বা গল্পের জন্য মাল্টিপল আর্টিস্ট এর কাজ রাখা হয়। আর মাল্টিপল আর্টিস্ট রাখা তো অনেকক্ষেত্রে পত্রিকার পক্ষে সম্ভব নয় তাই তারা ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট(কন্ট্রিবিউটর আর্টিস্ট) দের দিয়ে কাজগুলি করিয়ে নেয়। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় 'বিচ্ছু' ম্যাগাজিনে যখন কাজ করতাম তখন আমাকে আর আমার এডিটরকে অনেকে রিকুয়েস্ট করে বলতো ভাই আমিও কার্টুন আঁকি, আমার আঁকা দেখেন, পত্রিকায় ছাপেন প্লিজ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা সেই আঁকাগুলি দেখতাম আর বলতাম ভাই আমাদের লাগলে পরে আপনাকে জানাবো অথবা বলতাম ভাই আরো একটু ভাল করতে হবে আপনার আঁকা।

এমন না যে আমাদের আর্টিস্টের দরকার ছিলনা। কাহিনী হচ্ছে আমাদের আসলে একটু ভাল আঁকে এমন কন্ট্রিবিউটর আর্টিস্ট দরকার ছিল। আমি আর আমার এডিটর নিজেরাই কিছু কিছু কন্ট্রিবিউটর আর্টিস্টকে নক দিয়ে বলতাম ভাই আমাদের জন্য এটা এঁকে দেন। যুগান্তরে বিচ্ছুতে কন্ট্রিবিউটর আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করতো রিদম, মাহাতাব, মৌমিতা, সালমান সাকিব, শুভংকর তনি, দেবাদৃতা পিউ, ঐশিক, ইশমাম, রাকিব সহ অনেকেই। তারা তাদের হাজারো ব্যস্ততার মাঝেই আমাদের জন্য কার্টুন এঁকে দিতেন। এই আর্টিস্টরা দেশের অনেকগুলি পেপার ফিচার আর ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত আছেন এবং নিয়মিত আঁকছেন। এদের কেউ চারুকলার পড়াশুনা করছেন, আবার কেউ ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করছেন। কেউ কেউ আছেন এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। এমন না যে সবাই একদম ঘাঘু প্রফেশনাল। কিন্তু এরা ভাল কাজ করেন এবং দিনে দিনে নিজেদের কাজ উন্নত করছেন। এদের অনেকেরই কাজ করা বই,কমিক্স পাবলিশ হয়েছে এর মধ্যেই।

ব্লগের এই সিরিজের বড় বড় পোস্টগুলি লেখার একটাই কারন। কারনটা হচ্ছে একটা ব্যাপার ব্যাখ্যা করা। ব্যপারটা হল সবসময়ই কারো না কারো কাজের দরকার আছে। আপনি যদি মোটামুটি আঁকতে পারেন তবে আপনাকে দিয়ে কেউ না কেউ কাজ করাতে চাইবেই। তাই নিজের আঁকা কোথাও ছাপানোর আগ্রহের পাশাপাশি আঁকা ভাল করার প্রতিও আগ্রহ থাকতে হবে। আপনি যদি বিগিনার কার্টুনিস্ট/আর্টিস্ট হোন আর বিশেষ কোন পত্রিকার পাতায় বা ম্যাগাজিনে আঁকতে চান তবে সেই পত্রিকার পাতা অথবা ম্যাগাজিন ফলো করেন। ওই পাতার বা ম্যাগাজিনের আর্টিস্টরা কিরকম আঁকছেন সেটা ফলো করেন। উনাদের মতো আঁকতে না পারলেও অন্তত উনাদের আঁকার ধারেকাছে যেতে পারেন কিনা সেটার চেষ্টা করেন। কিপ প্র্যাকটিসিং।

এরপর কি করবেন সেটা বিস্তারিত জানতে চাইলে এই সিরিজের পরের পোস্ট পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে। আজকের মতো এ পর্যন্তই। বিদায়।

3 comments:

  1. Vaia ami jodi jol rong e aka cartoon scan na koira just jemon ase oivabei patahi taile ki amar kaj sapano hobe?(cartoon jodi valo hoy)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওয়াটারকালারে আঁকলে কোন সমস্যা নাই। প্রিন্টের জন্য ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ামে ড্রয়িং করলে আসলে স্ক্যান করে দেওয়াই বেটার। ছবি তুলে দিলে ঠিক কালারটা আসেনা। আমার কাছেও স্ক্যানার নাই। ট্র্যাডিশনাল ড্রয়িং প্রিন্ট করার প্রয়োজন হলে আমি কম্পিউটার-ফটোকপির দোকানে গিয়ে স্ক্যান করিয়ে নেই।

      Delete